avertisements 2

শ্রমবাজার তছনছ

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০৩ পিএম, ৪ জানুয়ারী,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৩৯ এএম, ২৩ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৪

Text

চট্টগ্রামের আনোয়ারার বাসিন্দা নিলয়। ২০১৩ সালে কাতার গিয়েছিলেন। কোম্পানির কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তিনবার বাড়িতেও এসেছেন। কিন্তু গত ২রা জানুয়ারি তৃতীয়বার দেশে আসার পর আর ফেরত যেতে

পারেননি। ছুটি শেষ হলেও করোনার কবলে পড়ে দেশেই বেকার জীবন পার করছেন এই রেমিট্যান্সযোদ্ধা। ছুটির মেয়াদ শেষ হয়েছে মাস ছয়েক হলো। এ অবস্থায় গত এক বছর জমানো অর্থকড়িই ভেঙে খেয়েছেন। ইতিমধ্যে কোম্পানির পক্ষ থেকেও তাদের কাতার ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

কিন্তু করোনা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। নিলয় বলেন, জমানো টাকা প্রায় শেষ। এরপর কি করবো, পরিবার কীভাবে চালাবো- সেটা নিয়েই চিন্তায় আছি।

শান্তা ইসলাম। নারায়গঞ্জের এই নারীও কাতার যাওয়ার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। এ জন্য দালালকে দিতে হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স নিয়েছেন, ভিসা পেয়েছেন, গত মার্চে ফ্লাইটের শিডিউলও নির্ধারণ হয়েছিল। কিন্তু করোনাঝড়ে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। এখন ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। উপরন্তু দালাল আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছে। সেই টাকা না দিলে ফ্লাইট চালু হলেও তার যাওয়া অনিশ্চিত বলে জানান তিনি। আর না গেলে পুরো আড়াই লাখ টাকাই খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তার। নিলয়ের মতো ছুটিতে এসে যেমন ফিরে যেতে পারেননি, তেমনি শান্তার মতো সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও আশায় প্রহর গুনছেন লাখ লাখ বিদেশগমনেচ্ছু নারী-পুরুষ।

পরিসংখ্যান বলছে, গত ১১ মাসে অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে মোট কর্মী গেছেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮২ জন। যা তার আগের বছর ২০১৯ সালের তুলনায় ৫ লাখ ১৬ হাজার ৪৭৭ জন কম। শতকরা হিসাবে এই হার ৭১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মার্চের পর অর্থাৎ এপ্রিল থেকে নভেম্বর- এই ৮ মাসে গেছেন মাত্র ২ হাজার ৪৬৪ জন। একই সময়ে দেশে ফেরত এসেছেন সোয়া তিন লাখের উপরে। বিপুল সংখ্যক এই কর্মী এখন দেশে বেকার জীবনযাপন করছেন। কবে শ্রমবাজার স্বাভাবিক হবে বা আদৌ হবে কিনা তা নিয়েই দুশ্চিন্তা তাদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা শীর্ষ গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট-রামরু’র এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯শে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮২ জন কর্মী উপসাগরীয় ও অন্যান্য আরব দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গেছেন। এদের অধিকাংশই এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে গিয়েছিলেন। যার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮১ হাজার ২১৮ জন। বিশ্বে লকডাউনের কারণে এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কোনো অভিবাসন হয়নি অর্থাৎ বিদেশে কোনো কর্মী যেতে পারেননি। ১লা অক্টোবর থেকে ১৯শে নভেম্বরের মধ্যে নতুন করে গেছেন ২ হাজার ৪৬৪ জন। করোনা অতিমারির আগে অর্থাৎ মার্চ পর্যন্ত বিদেশগমনের যে ধারা অব্যাহত ছিল তা চলতে থাকলে এই বছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে বছর শেষে কর্মী গমনের হার কমেছে প্রায় ৭১ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এ বছর সবার নজর ছিল- কর্মী গমনের চেয়ে প্রত্যাবর্তন অর্থাৎ ফিরে আসার দিকে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গত ১৮ই ডিসেম্বরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের ১লা এপ্রিল থেকে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন অভিবাসী কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। চাকরি হারিয়ে ফিরে আসার গতিটা প্রবল হয়েছে গত ৩ মাস ধরে। গড়ে প্রতিদিন ফিরে আসছেন প্রায় দুই হাজার কর্মী।

২৭শে আগস্ট প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১লা এপ্রিল থেকে ওইদিন পর্যন্ত ৫ মাসে ২৬টি দেশ থেকে চাকরি হারানোসহ নানা কারণে বিদেশে কর্মরত প্রায় ৮৫ হাজার ৭৯০ জন দেশে ফিরেছিলেন। কর্মী ফেরত আসার গতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত ৩ মাসে অভিবাসীদের দেশে ফেরার হার তার পূর্ববর্তী ৫ মাসের তুলনায় প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

রামরু বলছে, করোনাসহ বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের পতন, উপসাগরীয় দেশগুলোয় পর্যটন, সেবা ও নির্মাণখাতে কর্মরত অভিবাসীদের চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি কারণে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সব প্রস্তুতি শেষ করেও লকডাউনের কারণে যেতে পারেননি এক লাখ নতুন কর্মী।

নারী কর্মীদের অভিবাসনের গতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট ১৮ হাজার ৮১৩ জন নারীকর্মী বিদেশ গেছেন। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬ জন। পুরুষ কর্মীর মতোই এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত কোনো নারী কর্মী বিদেশ যেতে পারেননি। অক্টোবর থেকে সীমিত পরিসরে কিছু নারী কর্মী গেলেও এ ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে, ১লা এপ্রিল থেকে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত ৩৯ হাজার ২৭৪ জন নারীকর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। তাদের অনেকেই কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। আবার অনেকের ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও করোনার কারণে ফিরতে পারেননি। দেশে ফেরা নারী কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন সৌদি আরব থেকে। সংখ্যাটি ১৭ হাজার ৩১৬ জন। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফিরেছেন ৮ হাজার ৩৯৭ জন, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশ কাতার থেকে ফিরেছেন ৩ হাজার ৬১৪ জন, ওমান থেকে ফিরেছেন ২ হাজার ৫১৬ জন নারীকর্মী। এসব পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম ৫ মাসে নারী কর্মীদের ফিরে আসার হার কম থাকলেও সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নারী কর্মীদের ফিরে আসা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তথ্যমতে, ১লা অক্টোবর থেকে ১৯শে নভেম্বর পর্যন্ত নতুন করে যে ২ হাজার ৪৬৪ জন কর্মী বিদেশ গেছেন তাদের মধ্যে ৮৯১ জন ওমান, সৌদি আরবে ৮১৩ জন, উজবেকিস্তানে ৫২৪ জন, সিঙ্গাপুরে ৯১ জন, সংযুক্ত আরব-আমিরাতে ৬০ জন এবং আলবেনিয়ায় ২৪ জন গেছেন। উজবেকিস্তান নিয়মিত গন্তব্য দেশ না হলেও নতুন যাওয়া কর্মীদের ২১ শতাংশই গেছেন সেখানে।

গত বছরের অবস্থা এবং নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, গত বছরটি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে গেছে দেশের অন্যতম প্রধান খাত শ্রমবাজারের। তিনি বলেন, যেখানে বছরে ৫০ হাজার কর্মী ফেরত আসতো সেখানে ২০২০ সালে এ সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। আর যে পরিমাণ কর্মী বিদেশ যেতো তার চেয়ে ৪ গুণ কমেছে। এদের অনেকে কোভিডের কারণে চাকরি হারিয়ে, অনেকে ছুটিতে দেশে ফিরেছেন। এ ছাড়া বিদেশে প্রায় এক কোটি প্রবাসী নানা সমস্যায় আছেন। তিনি বলেন, এই অবস্থা দীর্ঘতর হলেও কীভাবে শ্রমবাজার স্বাভাবিক করা যায় তার পদক্ষেপ নিতে হবে। রূপরেখা তৈরি করে নতুন কর্মী পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। যে চার লাখ কর্মী দেশে ফিরেছেন তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করা, একইসঙ্গে যারা যেতে পারছেন না তাদের পুনর্বাসনে মনোযোগ দিতে হবে। বিদেশে অবস্থানরত কর্মীদের সমস্যা নিরসনে বৈদেশিক সহায়তা বাড়িয়ে, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। শরিফুল হাসান বলেন, করোনায় শ্রমবাজারের শুধু খারাপ দিকই নেই, এর একটি ভালো দিকও রয়েছে। করোনার ফলে কৃষিখাত, মেডিকেল টেকনোলজির মতো নানাখাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এ খাতগুলোকে টার্গেটে নিয়ে আমাদের দক্ষ কর্মী তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে।

উৎসঃ   মানবজমিন

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2