avertisements 2

নিজেকে অভিজাত মনে হয় (তিন) 

রাশেদুল ইসলাম
প্রকাশ: ১১:৪৩ পিএম, ২১ অক্টোবর, বুধবার,২০২০ | আপডেট: ০৮:৫৯ পিএম, ২৪ এপ্রিল, বুধবার,২০২৪

Text

 

এখন রমনা পার্ক উন্মুক্ত । সবার জন্য খোলা । আমি দাঁড়িয়ে আছি ওয়াকওয়েতে । আমার ডানদিকে জাতীয় টেনিস কমপ্লেক্সের প্রাচীর । বাদিকে রমনা লেক থেকে বেরিয়ে আসা নালা । নালার পানি কেমন  দুষিত মনে হয় যেন । লেকের পানি পরিস্কার করা হলেও, এখানকার  নালা- ডোবার পানি পরিস্কার করা হয়না বোধহয় । এরকম জায়গায় আমার দাঁড়ানোর কথা নয় । কিন্তু  প্রভাতের শুভ্র আলোয়  অগণিত পাখির কূজন শুনে দাঁড়িয়ে যায়  আমি । তারমানে রমনা পার্কের সব গাছে একইভাবে পাখি বসে না ।  কোন গাছে  অনেক পাখি বসে;   কোনটাতে একেবারেই না । 

বন্ধু হারুনের কথা মনে পড়ে আমার । তিনি  একবার সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর উপজেলায় এক পরিদর্শনে যান । সেখানে থানার আশেপাশের গাছগুলোতে ঝাকেঝাকে পাখি দেখে অভিভুত হন তিনি । কিন্তু উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে এসে অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন,  সেখানকার গাছে একটিও পাখি নেই । এর কারণ জানতে চাইলে,  উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিরক্ত হন । তিনি বলেন,  তাঁর অফিস আঙিনার গাছগুলোতে কেন পাখি বসে না, তা তাঁর জানার কথা নয় । তাঁর উত্তরে বন্ধুটি  বিরক্ত হন । থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে কথা  বলে  অবিলম্বে তাঁকে অফিস আঙিনা পাখিবান্ধব করার পরামর্শ দেন তিনি ।  লিখিত প্রতিবেদনেও  বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি  ।

 কয়েক বছর পরে বন্ধুটি যখন আরও উচ্চপদে আসীন; তখন একই  অফিসারকে  কুমিল্লায় বদলি করার একটা তদবির পান  তিনি । পুরনো স্মৃতি মনে হতেই, তিনি সেই অফিসারকে ডেকে পাঠান । অফিসার তাঁকে চিনতে  পারেন নি । কিন্তু বন্ধুটি তাহেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস আঙিনা পাখিবান্ধব করার প্রশ্ন তুললে,  তিনি তাঁকে চিনতে পারেন  এবং আগের মতই  বিরক্ত হন । তিনি আগের মতই   জানান, গাছে পাখি না বসলে,  কোনকিছু করার নেই তাঁর । এ ধরণের উত্তরে বন্ধুটি আবারও  বিরক্ত হন । তিনি তাঁকে কুমিল্লায় বদলি না করে,  একটি পাহাড়ি অঞ্চলে বদলী করেন । তাঁর মনে হয়েছে  প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কোন  কর্মকর্তাকে অবশ্যই  পরিবেশ বান্ধব হতে হবে;  পাখি বান্ধব হতে হবে । 

আমি বন্ধু হারুনের সাথে একমত ।  পরিদর্শনকালে তাঁর এ ধরণের   তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আমাকে মুগ্ধ করে । এর সাথে দেশপ্রেমেরও একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে ।  জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে পৃথিবীর ঝুঁকিপ্রবণ দেশের শীর্ষে বাংলাদেশ  । সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনের কারণে এদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি  মানুষের জীবনযাত্রার  মানের উন্নতি হয়েছে সত্য; তবে উন্নয়নের  পাশাপাশি নগরায়ন বেড়েছে । ব্যাপক হারে পাহাড় ও গাছপালা কাটা পড়েছে । পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার মত প্রয়োজনীয় বনভূমি আমাদের নেই । এ অবস্থায় দেশের  সকলে যাদি পরিবেশ বান্ধব না হয়;  যার যার  বসতবাড়ি এবং অফিস আঙিনা যদি পরিবেশ বান্ধব না হয়;   তাহলে ভবিষ্যতের ভয়াবহ দুর্যোগ ও  দুর্গতি আমাদের  অনিবার্য পরিণতি হতে পারে ।

আমি বোধহয় বিষয়বস্তুর বাইরে চলে  গেছি । বাস্তবে  আমি এখন রমনা পার্কের একটা প্রাচীন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে । গাছটির বয়স কত ? আমি অনুমান করার চেষ্টা করি । গাছের বয়স নির্ণয়ের একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে ।  কিন্তু সাধারণ কলা বিভাগের ছাত্র আমি । সেই হিসাব পদ্ধতি আমার  জানা নেই । তবে ইতিহাস আমার জানা । আমি  ঐতিহাসিক ঘটনা দিয়ে গাছটির বয়স জানার চেষ্টা করি । 

মোগল  সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ সালে ঢাকাকে সুবে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন । তিনি সুবেদার ইসলাম খান চিশতীকে সুবেদার নিযুক্ত করেন । এই নিয়োগে খুশী হয়ে সুবেদার ইসলাম খান ঢাক বাজিয়ে আনন্দ উৎসব করেন  । কথিত আছে,  সেদিনের  ঢাক বাজিয়ে অনুষ্ঠান করা মানুষের মনে এমন প্রভাব ফেলে যে, এই নগরীর নাম পরবর্তীতে ঢাকা হয়ে যায় । আবার অনেকে বলেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কারণে  এই নগরীর নামকরণ করা হয় ঢাকা । তবে ১৬১০ সালে  সুবেদার ইসলাম খান ঢাকা নগরীর পত্তন ঘটান  এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের নাম অনুসারে তখন  রাজধানীর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর ।  রমনা নামটি মোঘলদের দেওয়া । সুবেদার ইসলাম খান রমনা সংলগ্ন এলাকাকে  একটি অভিজাত  আবাসিক এলাকা হিসাবে গড়ে তোলেন । কিন্তু  পরবর্তীতে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তর করা হলে, ঢাকা নগরীর গুরুত্ব কমে যায় এবং ধীরে ধীরে রমনা অঞ্চল ঘন জঙ্গলে পরিণত হয় । তবে  আমার সামনের গাছটি সেই সময়ের নয় ।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলের কথা । ১৮২৫ সালে  ব্রিটিশ কালেক্টর  ডাউইজ ঢাকা নগর উন্নয়নের পদক্ষেপ নেন । তিনি রমনা পার্কের দক্ষিন দিকটা ঘিরে ঘোড়দৌড়ের মাঠ তৈরি করেন । ইংরেজ বীরের জাতি । ইউরোপের ছোট একটা দেশের প্রতিকুল পরিবেশে বেড়ে ওঠা  ইংরেজ  টগবগে ঘোড়ার মত গোটা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ায় । ঘোড়দৌড় বা রেসকোর্স তাই তাদের রক্তে উন্মাদনা জাগায় । মূলত পূর্ব বাংলায় কর্মরত  ইংরেজেদের   চিত্তবিনোদনের জন্যই রমনার দক্ষিণ দিকে গড়ে ওঠে রমনা  রেসকোর্স ময়দান । পরবর্তী কালে ঢাকার নবাব পরিবার পুরনো হাইকোর্ট ভবন এলাকা থেকে রমনা গ্রিনের   বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একটি রাজকীয় বাগান গড়ে তোলেন ।  সেই বাগানের নাম দেন, ‘শাহবাগ’  । বাংলাদেশ  স্বাধীন হওয়ার পর  রমনা  রেসকোর্স ময়দানের  নামকরণ হয় ‘সোহরাওয়ার্দি উদ্যান’ ।  তবে আমার সামনের  গাছটি সে সময়েরও নয় বলে আমার মনে হয় । 

 প্রকৃতপক্ষে আধুনিক রমনা পার্ক প্রতিষ্ঠার মূল পরিকল্পনা হয় ১৯০৮ সালে । ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের আদেশে পূর্ববাংলা এবং আসামকে  নিয়ে  একটি ভিন্ন  প্রদেশ গঠন করেন ।  প্রাদেশিক রাজধানী হয় ঢাকা । তখনকার অভিজাত ইংরেজদের মনোরঞ্জনের জন্যই মূলত লন্ডনের কিউই গার্ডেনের অনুরূপ একটি গার্ডেন প্রতিষ্ঠার জন্য মিঃ প্রাউডলককে ঢাকায় আনা হয় । প্রাউডলক ছিলেন কিউই গার্ডেনের অন্যতম একজন কর্মী । আমার মনে হয়  সামনের গাছটি প্রাউডলকের প্রথম দিকে লাগানো একটি গাছ । আমার ধারণা ঠিক হলে গাছটির বর্তমান বয়স ১ শত ১২ বছর ।  অবশ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাছটির প্রকৃত বয়স  বের করা সম্ভব । 

C:\Users\User\Desktop\121614269.jpgC:\Users\User\Desktop\121254719.jpg

C:\Users\User\Desktop\121451584.jpgC:\Users\User\Desktop\121382714_.jpg

 

আমি লেকের গাঁ ঘেঁষে ওয়াকওয়ে বরাবর হাঁটতে থাকি । সবুজ গাছপালা ঘেরা লেকের পানি সবুজাভ মনে হয় । ৮.৭৬ একর আয়তনের এই লেক রমনা পার্কের অনুপম সৌন্দর্যের একটি বড় কারণ । আমি লেকের ছবি তোলার চেষ্টা করি । 

রমনা পার্কে ঢোকার  বেশ কয়েকটি  গেট আছে । তবে মিনটো রোড সংলগ্ন গেটটি দেখলেও বোঝা যায় সেটি  একমাত্র ভিআইপি গেট । গেটের নাম ‘অরুণোদয়’ । মিনটো রোড সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত  অভিজাত শ্রেণির বাসিন্দাদের জন্যই গেটটি করা । গেটের ডানদিকে আর একটু হাঁটলে  আরও  একটি গেট । সেটি মূলত ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের অভিজাত মেহমানদের জন্য । যে কোন  পাঁচতারকা হোটেলে ব্যায়ামাগার থাকে । কিন্তু আমার মত  অনেকে  আছেন, যারা চার দেয়ালের মধ্যে ব্যায়াম করতে চান না । তাঁদের কথা ভেবেই  মূলত গেটটি তৈরি হয়েছে । 

 

ভিআইপি গেট দিয়ে ঢুকলেই বাদিকে মহিলা অঙ্গন । এর চারদিকটা ঘেরা । অভিজাত এলাকার বায়ু সেবনকারী মহিলাগণ এখানে  নিজেদের মত ব্যায়াম করে থাকেন 

 

(চলবে ) 

 ইস্কাটন, ঢাকা  । ১৬ অক্টোবর, ২০২০ ।

 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2