গুজবও তথ্যপূর্ণ কিন্তু যাচাইকৃত নয়!!

মোঃ শফিকুল আলম: গুজব প্রচলিত হয়ে যায় এবং মুখে মুখে। মানুষের মতামত নয়। এখানে কারও মতামত দেয়ার সুযোগ থাকেনা। কিন্তু এটি ‘গ্রুপ সংবেদনশীলতা কার্যকলাপ’। যারা ছড়ায় তারাও দ্বিধান্বিত কিন্তু ছড়ায়। কেনো ছড়ায়? দ্বিধান্বিত পরিস্থিতি বুঝতে চায়।
সৃষ্টির শুরুতেই গুজব ছিলো। এখনও আছে। অস্থিতিশীল এবং দ্বিধান্বিত সমাজে গুজব থেমে থেমে আসে এবং একটি সময়কাল পর্যন্ত স্থায়ী থেকে সমাজের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে এমনিতেই শেষ হয়। উন্নত এবং স্থিতিশীল সমাজে গুজবকে ফান হিসেবে উড়িয়ে দেয়া হয়। সকলে বেশ উপভোগ করে। উন্নত সমাজে এখন আর গুজব প্রভাব ফেলেনা। কারন এই সমাজ যুক্তিবাদী। সবকিছুতে যুক্তি খোঁজে। যুক্তিসংগত নয় এমন কিছু তাদের প্রভাবিত করেনা।
তারপরও আমাদের মনে থাকার কথা ১৯৯১ সালে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান-আমেরিকান কমিউনিটিতে একটি গুজবের কারনে কিভাবে একটি সোডা ওয়াটার কোম্পানীর বিক্রয় রাতারাতি ৭০% কমে গিয়ে কোম্পানীটি পথে বসেছিলো। গুজবটি ছিলো এরকম যে ‘ট্রপিকাল ফ্যান্টাসি সোডা পপ’ এর সোডা ওয়াটার কালো মানুষেরা পান করলে তাদের স্পার্ম নষ্ট হয়ে বাঁজা হয়ে যাবে। এটি বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছে!
মানুষ কখন গুজব ছড়ায়? যখন অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, দ্বিধাগ্রস্ততা বিদ্যমান থাকে। যখন খারাপ ঘটনা কেনো ঘটছে তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকেনা এবং এই ঘটনা ঘটার ওপর দৃশ্যত: কারও নিয়ন্ত্রন লক্ষ্য করা যায়না তখন গুজব তীব্রাকারে ছড়ায়। ১৯৫৫ সালে গুজব ছড়ানোয় অনিশ্চয়তা কতোটা ভূমিকা রাখে তা’ প্রমানে মনস্তাত্বিক গবেষকরা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কোনো কারন ব্যাখ্যা না করে একজন ছাত্রকে উইথড্র করার ফলে দেখতে পেলেন সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পরে।
উদ্বিগ্নতা গুজব ছড়ানোর অন্যতম কারন। অনিশ্চয়তা অধিকাংশ সময় উদ্বিগ্নতার জন্ম দেয়। আমরা পৃথিবী, রাষ্ট্র বা সমাজ থেকে একটি পরিষ্কার ধারনা পেয়ে প্রতিদিন শুরু করতে চাই। পরিষ্কার ধারনা না থাকলে মানুষ দ্বিধান্বিত হয় এবং গুজবে কান দেয়। একটি সমীক্ষায় একটি শ্রেনীর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে একটি গ্রুপকে নিয়ন্ত্রনে রেখে আসন্ন চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য প্রতিনিয়ত ব্রিফ করা হয়েছে এবং অন্য গ্রুপটিকে পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো তথ্য সরবরাহ না করে দেখা গেছে নিয়ন্ত্রিত এবং নিয়মিত যে গ্রুপটিকে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে তাদের মধ্যে কোনো উদ্বিগ্নতা ছিলোনা বা কোনো বিভ্রান্তি তৈরী হয়নি। অপরপক্ষে অনিয়ন্ত্রিত এবং তথ্যবন্চিত গ্রুপের মধ্যে নানান গুন্জন তৈরী হয়েছে। এমনকি উদ্বিগ্নতা এবং হতাশা তাদের অনেককেই অসুস্থ করে ফেলেছিলো।
মানুষ গুজব ছড়ায় যখন গুজব-তথ্যটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আগেই বলেছি তথ্য যাচাই করা হয়না। তথ্য যে ছড়ায় সে এমনকি এই তথ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেনা জেনেও ছড়ায়। কারন সে মনে করে অন্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বটে!
আবার চলোমান গুজব-তথ্যটি অনেকে বিশ্বাস করে ছড়ায়। আবার গুজবের তথ্যটি অনেক সময় অধিকাংশের কাছে বিশ্বাসযাগ্য মনে হলে এমনকি বিশ্বাস না করলেও এই যে বিশ্বাসযাগ্য মনে হলো সে কথাটি বলার কারনেও ছড়ায়।
অনেক ক্ষমতাবান মানুষ নিজের ইমেইজ প্রতিষ্ঠার জন্য বা প্রতিপক্ষের ইমেইজ ক্ষুন্ন করার জন্যও গুজব ছড়ায়। অসংখ্য গবেষনায় প্রমানিত যে মানুষ নিজের ইমেইজ প্রতিষ্ঠায় তার সম্পর্কিত গুজব ছড়াতে পছন্দ করেন। অন্যভাবে প্রতিপক্ষের সুনামকে ক্ষুন্ন করার গুজব ছড়িয়ে নিজেকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করে।
এক্ষেত্রে সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ নিজের বা নিজেদের গুরুত্ব পূনর্প্রতিষ্ঠার জন্য বা নিজেদের গুরুত্ব কমে গেলে বা প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের গুরুত্ব বেড়ে গেলেও নিজেদের সামাজিক বন্ধন পূন:প্রতিষ্ঠার জন্যও গুজব ছড়ায়। অন্যের কাছ থেকে সম্মান আদায়ের জন্য অপকৌশল হিসেবেই গুজব ছড়ানো হতে পারে।
ওপরের সব কথাই মনস্তাত্বিকগনের - আমার নয়। এতো গভীরে আমি ভাবতে পারিনা। আমি গভীরে প্রবেশ করতে চাইনা। ভাবতে গেলে যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় তা’ আমি নিতে পারিনা। টেলিভিশনের সামনে বসে জ্ঞানীগনের আলোচনা শুনলে পরক্ষণেই একটু হাল্কা বিনোদনের জন্য নাটক বা সিনেমা দেখে নিজেকে হাল্কা করে নেই।
মানুষের সাথে মানুষের নিষ্ঠুরতা, প্রতারনাও আমাকে কষ্ট দেয়। কোনো বিভৎস দৃশ্য দেখা থেকে বিরত থাকি। হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। শাসকগোষ্ঠীর জনগনের সাথে প্রতারনাও ব্যথিত করে। বিচারহীনতা বা বিচারের নামে রাষ্ট্র যখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে তখন আরও কষ্ট পাই। গনতন্ত্রের নামে ভোটাধিকার হনন বা আইনের শাসনের নামে দেখে দেখে আইন প্রয়োগ সত্যিই ব্যথিত করে।
গুজব কেনো কখন কিভাবে একটি সমাজে সৃষ্টি হয় তা’ উপরে মনস্তাত্বিকগনের বিশ্লেষনে রয়েছে। আপনারাও হয়তো জানেন। তারপরও কেনো আলোচনা করলাম? করলাম এই কারনে যে কেনো বাংলাদেশে গুজব এই মূহর্তে মানুষকে মানুষ হত্যায় প্ররোচিত করছে তা’ কিছুটা বোঝার জন্য। নানানভাবে সমাজে সামাজিক অস্থিরতায় মানুষ সুনির্দিষ্ট এবং বিশ্বাসযাগ্য কোনো তথ্য পায়না। মানুষ উদ্বিগ্ন এবং দ্বিধান্বিত। মানুষ বুঝতে পারছেনা অন্যায়ের বিপরীতে ন্যায্যতা কে প্রতিষ্ঠিত করবেন, কখন করবেন বা আদৌ কেউ করবেন কি-না। অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র, সরকার, বিচারবিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমুহ কাজ করবে না জনগন নিজেরাই আইন কার্যকর করবে।
এই মুহূর্তে মানুষ সত্যিই বুঝতে পারছেনা কোনটি সত্য? ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম কি বলাতে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রহীতার মামলা হলো এবং অনেকদিন কারাগারে থাকতে হলো। বুঝতে পারছেনা কেনো প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রহীতার মামলা হবেনা। না-কি কারও বিরুদ্ধে হওয়া উচিত নয়। মানুষ টোটাললি কনফিউজড্।
মানুষ বুঝতে পারছেনা বন্যাকবলিত মানুষের কাছে সরকার, সরকারি দল, ছাত্রসংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন কখন দাঁড়াবে? সমাজে চলোমান গুজব বন্ধে কখন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সবার কাছে গিয়ে বলবে গুজবে কান দিবেননা। মানুষ মানুষকে হত্যা করা আইনবিরোধী। অপরাধীকে আইনে সোপর্দ করে বিচারের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। পুলিশ কখন মানুষের বন্ধু হয়ে নিরপোরাধ মানুষকে অপরাধের বেড়াজালে আটকাবেনা? অযোগ্য রাজনীতিকরা কখন যোগ্য নাগরিকদের ওপর শাসকের ছড়ি ঘোড়াবেনা?
শাসক গোষ্ঠীর সমর্থকরাই বা কখন বলবেন ডেঙ্গু মহামারী আঁকার ধারন করেছে? চিকিৎসাব্যবস্থাই ডেঙ্গুর কারনে ভেংগে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কুম্ভকর্নদের ঘুম কিছুতেই ভাংছেনা। অনেকটাই রোমনগরী আগুনে ভস্মীভূত হওয়ার সময় শাসকের বাঁশী বাজানোর সমতুল্য। আমি বেশ হাল্কা চিন্তা করি। এরই মধ্যে ভারী কথা বলে ফেলায় নাক-কান অনেকটা অগ্নিরুপ ধারন করেছে। আজ আর লিখতে পারবোনা। শুধু শিশু তুবা এবং সম্মিলিত উচ্ছৃংখল জনতার নির্মম প্রহারে নিহত তাসলিমার কাছে ক্ষমা চেয়ে শেষ করলাম।