বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একজন সিরাজুল করিম

দেশের বহুমাত্রিক এক প্রতিভার নাম সিরাজুল করিম । তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সাবেক কন্ঠশিল্পী ও নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, কৃষি প্রযুক্তিবিদ ও সাবেক ছাত্র নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানি । যিনি সোজা কথা সোজাভাবে বলার মানুষ। যা আজকের দিনে পাওয়া বড় দুষ্কর। তার আরো একটি বড় গুণ তিনি এক নির্লোভ ব্যক্তি।
বর্তমানে দেশে মুক্তচিন্তা, সামাজিক অবক্ষয় রোধ, সাহিত্যচর্চা, ক্রীড়াচর্চা, ইতিহাস লালন ও ধারণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশে যে কয়জন অগ্রগণ্য রয়েছেন তিনি তাদেরই একজন।
সিরাজুল করিম এর জন্ম ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এবং পুরোনো ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের জন্যেই তাঁর গ্রামের নাম বীরগাঁও। কবি ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল করিম এর পূর্ববর্তী সপ্তম পুরুষ আগের মুন্সী ওয়ালী উল্লাহ ছিলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার রাজকর্মচারী আর চতুর্থ পুরুষ মুন্সী ছমির উদ্দিন প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি বহুভাষায় পারদর্শী।
সিরাজুল করিম মাৎস্য বিজ্ঞানে স্নাতক সম্মান ও ¯ স্নাতকতকোত্তর ডিগ্রী নিয়ে ২১ জুন ১৯৭৭ খিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরে প্রথম শ্রেণীর পদে চাকরি শুরু করে পরিচালক হিসেবে ৩১ অক্টোবর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে পূর্ণ অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ২০১১ থেকে ২০১৫ খ্রিঃ ইউএসএইড (USAID) এবং ইউএনডিপি (UNDP) সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।
কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক ও কৃষি প্রযুক্তিবিদ সিরাজুল করিম এর বাংলা-ইংরাজী ভাষায় রচিত কবিতা, প্রবন্ধ ও প্রযুক্তিগত লেখা প্রযুক্তি ও উন্নয়ন গবেষনা আর সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সফলতার জন্যে।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আজ অব্দি বিভিন্ন সময় ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, থাইল্যান্ড, জাপান, সুইডেন , ভারতসহ বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত ও প্রশংসিত হয়। বর্তমান বিশ্বায়নের চলমান প্রেক্ষাপটে তিনি ১৯৯০ খ্রিঃ যুক্তরাজ্যে, ১৯৯৬ খ্রিঃ থাইল্যান্ডে, ২০০১ খ্রিঃ জাপানে, ২০০৫ খ্রিঃ গণচীনে, ২০১৬ খ্রিঃ ভারতে এবং ডিসেম্বর ২০১৭ খ্রীঃ অস্ট্রেলিয়ায় সংবর্ধিত হন।
মৎস্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (এফ টি আই) এর অধ্যক্ষ হিসাবে বাংলাদেশে প্রথম মৎস্য ডিপ্লোমা কোর্স চালু, কলেজপাঠ্য ২টি কৃষিবিজ্ঞান, জাতীয় বিশ্বদ্যিালয়ের আওতায় স্নাতক পর্যায়ের পাঠ্য- ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ ও ‘বাংলাদেশ স্টাডিস ইতিহসি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’ এবং সমৃদ্ধ ২২টি পাঠ্যসহায়কসহ বিভিন্ন শাখায় প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থের মাধ্যমে কবি ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল করিম বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও উৎপাদন-অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন।
তিনি একজন প্রথিতযশা লেখকও। তার লেখায় রয়েছে সরলতা। যা সহজেই পাঠকের মনে স্থান করে নেয়। তিনি একজন শক্তিমান লেখক এবং নির্ভীক কলম সৈনিক। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা।
বহুমাত্রিক অনন্য সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী তিনি।আমাদের সমাজে একই সাথে এতো গুণের সমাহার তেমনটি দেখা যায় না। এখানে যারা সাহিত্য করেন সাধারণত তাঁরা অন্য বিষয়ে আগ্রহী থাকেন না। আবার যারা গবেষণা বা অনুবাদে অবদান রাখেন তাঁরা মৌল সাহিত্যের বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী হন না। যারা বিভিন্ন ভাষা জানেন তাঁরা হয়তো অনুবাদ করতে পারেন, কিন্তু মৌলিক সাহিত্যে তেমন অবদান রাখতে সক্ষম হন না। এক্ষেত্রে সিরাজুল করিম যেন ক্রিকেটের ভাষায় অলরাউন্ডার। তিনি সকল বিষয়ে সমান দক্ষতা ও পান্ডিত্যের ছাপ রেখেছেন। এটা একটি বিস্ময়কর বিষয় বটে!
ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরোধা পুরুষ, সত্য, ন্যায়, সমাজ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে লিখেছেন অনেক বই। যা আছে পাঠকদের হাতে হাতে।
কবি ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল করিম এঁর লেখালেখির শুরু ১৯৫৯ সনে শুরু হলেও ১৯৬৪ সনে তাঁর ‘মিনতী’ নামক ছড়াটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে কার্যকর ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সিরাজুল করিম বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য (জীবন-১৪৮৮), কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের জীবন সদস (নম্বর -০৬-৭৬-১৬৭০), বিএসটিকিউএম এর জীবন সদস্য (০৭০৫৩০ জীবন) এবং বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ জরাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের জীবন সদস্য (১৪১৪)।
সিরাজুল করিম এর প্রকাশিত গ্রন্থাবলির মধ্যে- কাব্যগ্রন্থঃ বহুসংখ্যক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে- প্রিয়তমা মানসী আমার, কবিতা আমার রহস্যের রমণী,Love and Memories, , প্রত্যাশার ঘোড়া আসেনা জনতার কাছে, শিল্পিত স্বপ্নিল বার্তা ইত্যাদি; উপন্যাসঃ উপন্যাসের মধ্যে- অনিতার ঘরে প্রেম, বৃটেনের স্মৃতি ইত্যাদি; গল্পগ্রন্থঃ গল্পগ্রন্ধের মধ্যে-হৃদয়ে প্রেমের বসত, তালাক ইত্যাদি; প্রবন্ধগ্রন্থঃ বহু প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির পথে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিক অধিকার-প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, Threatened Nature And Women In Bangladesh ইত্যাদি; প্রায়োগিক বিজ্ঞান (পাঠ্য সহায়ক)ঃ মাছ চাষের সার কথা, মৎস্য খামার স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা, চিংড়ি চাষের করাকৌশল, আধুনিক পদ্ধতিতে ফুলের চাষ, আধুনিক পদ্ধতিতে হাঁসমুরগি পালন ও চিকিৎসা, Aquafood Safety Production Management ইত্যাদি; আত্মজীবনীগ্রন্থঃ সিরাজুল করিম-এর যাপিত জীবনের কাব্য (ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যের); শিশুসাহিত্যগ্রন্থঃ মহানবীর(সাঃ) শিশুপ্রীতি, নদীর কাছে পাখির কাছে, জ্বিন-পরী ভূত পেতনির মজার গল্প ইত্যাদি। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যগ্রন্থঃ কারিকুলাম বোর্ডের কলেজ পর্যায়ে কৃষিবিঞ্জান প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্র এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রী ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে (অনার্স ও পাশকোর্স) আবশ্যিক পাঠ্য ’স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ ও ‘বাংলাদেশ স্টাডিসঃ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’
২০০২ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজুল করিম এর ৫০ পূর্তি অনুষ্ঠানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য জাতীয় অধ্যাপক আবুল কালাম মুহাম্মদ আমীনুলহক বলেন, ‘আমার বিশ্বাস সব্যসাচী লেখক সিরাজুল করিম তাঁর ছড়ায়, কাব্যে, প্রবন্ধে, কথাসাহিত্যে কিংবা কৃষিবিজ্ঞান লেখার মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলবেই।’ সাহিত্যিক মোবারক হোসেন এর ভাষায় ‘প্রতিকুলতাকে ঠেলেই জীবন গতিশীল এটাই সিরাজুল করিম এর লালিত বিশ্বাস ও উপলব্ধি, নারীর ভেতরে তিনি আবিস্কার করেছেন আরেক অনন্য নারীকে এবং তুলে ধরেছেন অপ্সরী করে।’ কবি আল মাহমুদ এঁর মতে ‘কবি ও কৃষিবিজ্ঞানী সিরাজুল করিম একজন মননশীল সাহিত্যকর্মী, বহুদর্শী মানুষ ও পরিশ্রমী কৃষিবিদ এবং তাঁর কাব্যচর্চাও স্বতঃস্ফুর্ত।’
কবি শামসুর রাহমান এঁর মতে ‘সিরাজুল করিম দেশের মানুষের প্রগতি ও কল্যাণের কথা বলেন তাঁর কবিতায়, তিনি যেমন সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করেছেন তাঁর কিছু কবিতায় তেমনি বলেছেন প্রেমের কথাও।’
কবি, প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক সিরাজুল করিম জাতীয় সাহিত্য পরিষদ এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, নারী উন্নয়ন-অধিকার ও নিরাপত্তা ফোরাম এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, গণমানুষের প্রতিনিধিত্বশীল ‘সাপ্তাহিক গণপ্রহরী’ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক, বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ইতিহাস মঞ্চের প্রধান উপদেষ্টা, বঙ্গবন্ধু গবেষণা ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা, ভাষা আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উপদেষ্টা, বঙ্গবন্ধু সাহিত্য জোট এর প্রধান উপদেষ্টা (স্থায়ী) ও মাসিক সিএনএম সংবাদের প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন সংগঠন সম্পৃক্ততায় শতাধিক গ্রন্থ রচনায় সাহিত্য-সাংস্কৃতিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন। সিরাজুল করিম ১৯৯০ খ্রিঃ তাঁর ‘মহানবীর(সাঃ) শিশুপ্রীতি’ গ্রন্থটি পুরস্কৃত প্রাপ্তির পর থেকে ছাত্রছাত্রীদের দাদু হয়ে ৫টি সদোপদেশ দিয়ে আসছেন আজঅব্দি যার সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি। কবি ও প্রযুক্তিবিদ সিরাজুল করিম সার্বিক কৃষি উৎপাদন-অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বর্ণপদক ২০০২ এবং সাহিত্যে দি গোল্ডেন ডিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০০৩, ফকলোর চর্চা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৪, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ পদক ২০০৬, লেখক কল্যাণ সংস্থা পদক ২০০৭, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক ২০১৩, ভারতীয় বাসভূমি পত্রিকা জীবনকৃতি সম্মাননা ২০১৬, ভারতীয় চাতক সাহিত্য পত্রিকার সম্মাননা ২০১৬, অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী ‘আমরা বাংলাদেশী‘সম্মাননা ২০১৭সহ ২৫টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক/পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। কবি, প্রবন্ধিক ও প্রযুক্তিবিদ সিরাজুল করিম এর সার্বিক কৃষি প্রযুক্তি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন গবেষনা এবং সমৃদ্ধ গবেষনালব্দ প্রকাশনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার`Prize of the President of the Republic for World Solidarity 2009 এবং`5th Okinawa Peace Prize’ দু’টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্যে তাঁর নাম বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সনে প্রস্তাব করে।
তার স্ত্রী সাবেক স্কুল শিক্ষিকা, প্রাবন্ধিক পারভীন সুলতানা, কবি ও স্থাপত্যবিদ ছেলে মোঃ সজীবুল করিম শিপলু আর চিত্রশিল্পী ও চিকিৎসক মেয়ে সাবরিনা করিম জিনিয়া প্রায়সকলেই সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সম্পৃক্ত।
সিরাজুল করিম গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে সিডনিতে অবস্হান করছেন এবং জুন মাসে তার দেশে ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে। সিডনিতে অবস্হান কালে তার মোবাইল নাম্বার ০৪৪৪৫৬৩৫৯১।