‘সাদপন্থীরা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে টঙ্গীর ইজতিমা ময়দান ও তাবলিগকে কলঙ্কিত করেছে’

আসন্ন বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে টঙ্গীর ইজতিমার ময়দানে কর্মরত তাবলিগি সাথী, উলামায়ে কেরাম ও মাদরাসা ছাত্রদের উপর ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী ভারতের নিজামু্দ্দিনের মাওলানা সাদের অনুসারীরা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে নৃশংস হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কাকরাইলস্থ তাবলীগের মুরব্বীরা।
শনিবার টঙ্গীর ইজতিমা ময়দানে তাবলীগের স্বঘোষিত আমীর ভারতের মাওলানা সাদ ও বাংলাদেশী ওয়াসিফের অনুসারীদের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে রোববার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তাবলীগের মুরব্বী মুফতি আমানুল হক তার লিখিত বক্তব্যে এসব অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, সাদপন্থী গোমরাহীরা অন্যায়ভাবে বর্বর হামলা করে বিশ্ব ইজতিমার শান্তিপূর্ণ প্রস্তুতি-কাজকে যেমন নষ্ট করে দিয়েছে, তেমনি যুগ যুগ ধরে উপমহাদেশের মুসলমানদের এই মিলনস্থলকে অপমানিত ও অসম্মানিত করেছে। তাদের গোমরাহীর কারণে আজ ইসলামের মহান খেদমতে নিয়োজিত তাবলিগ জামাত সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে।
মুফতি আমানুল বলেন, সাদপন্থীরা যে গোমরাহী মতাদর্শে বিশ্বাস করে নিরস্ত্র মুসল্লী-মুসলিম ভাইদের উপর তাদের এই সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী হামলা তা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
তিনি তার বক্তব্যে বলেন, নানান কারণে আসন্ন টঙ্গী ইজতেমার মাঠের কাজ এই বছর বিলম্বিত হয়। তাই ঢাকার সাথী ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা ৩ দিনের জামাতবদ্ধ হয়ে টঙ্গীর মাঠের কাজ আঞ্জাম দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের উপর দিল্লির নিজামুদ্দিনের মাওলানা সাদ-এর অনুসারী ওয়াসিফুল ইসলাম ও নাসিম গংরা নিরীহ-নিরস্ত্র সাথী, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপর লাঠি-সোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে এ সময় পুলিশের ভূমিকা ছিলো নীরব ও রহস্যজনক। পুলিশ এ সময় দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঠে প্রবেশ করতেও সহযোগিতা করে তারা। কিন্তু প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেছিলো আপনারা ভেতরে থাকেন। আমরা বাইরে দেখছি। বাহির থেকে কেউ ভেতরে যেতে পারবে না।’
‘প্রশাসনের কাছে জাতির প্রশ্ন সারা দেশ থেকে হাজার হাজার সাদপন্থী টঙ্গীতে একত্র হলো কীভাবে?’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়ায় যে সমস্ত ছোট ছোট মাদরাসার ছাত্র দেখানো হয়েছে তারা মূলত টঙ্গী মাঠের ভেতরে অবস্থিত মাদরাসার ছাত্র। এই মাদরাসাটি কাকরাইলে অবস্থিত মাদরাসার শিশু বিভাগ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ভিডিও ফুটেজে যেসব শিশুদের দেখানো হয়েছে তারা সেই মাদরাসারই ছাত্র। তাদের সেখানে নেয়া হয়নি; বরং তারা সেখানে থেকেই লেখাপড়া করে।’
পরবর্তীতে তিনি মাওলানা সাদ সবার সিদ্ধান্তের বাইরে কীভাবে নিজেকে আমির হিসাবে দাবি করলেন এবং তাকে কেন মান্য করা সম্ভব নয় সংক্ষেপে তা তুলে ধরেন।
লিখিত বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরও দেন মাওলানা আমানুল হক।
‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিসের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, নির্বাচনের আগে দুই পক্ষের কেউ জমায়েত হবে না’ এমন প্রশ্নের উত্তরে মুফতি আমানুল হক বলেন, ‘টঙ্গীর ইজতেমার প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য প্রায় ছয় মাস সেখানে থেকে কাজ করতে হয়। শেষের দিকে প্রতিদিন ৫-৬ হাজার সাথী কাজ করেন এবং শুক্রবার ৩০ হাজার সাথী কাজ করেন। এটাকে আমরা জমায়েত বলি না। এটা কাজের জন্য যাওয়া।’
একই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, প্রশাসন ইজতেমা স্থগিত করেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন যথা সময়ে হলে ইজতেমাও যথা সময়ে হবে। যদি ইজতেমা যথা সময়ে হয় তাহলে তার প্রস্তুতি তো এক সপ্তাহে শেষ করা যাবে না। তাই ইজতেমার প্রস্তুতির কাজ চলছিলো। আমাদের প্রশ্ন নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও তারা সেখানে কীভাবে পৌঁছালো? আমাদের প্রশাসন কি এতোই দুর্বল?’
‘আহতদের তালিকায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বেশি দেখা গেছে এবং সাধারণ সাথীরা কি আপনাদের প্রতি আস্থাহীন?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে মুফতি আমানুল হক বলেন, দাওয়াতের কাজ কোনো নির্ধারিত শ্রেণির জন্য নয়। তাহলে মাদরাসার ছাত্ররা কেন অংশ নিতে পারবে না? মাদরাসার ছাত্ররা আগেও শুক্রবার এসে কাজ করেছে। সমস্যা না হওয়ায় তা চোখে পড়েনি। সাধারণ সাথীরাও ছিলো শুক্রবার হওয়ায় মাদরাসা ছাত্ররা অন্যদিনের তুলনায় বেশি ছিলো।
মামলা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘টঙ্গীর ঘটনার জন্য মামলার বিষয়টি আহত ব্যক্তি, তাদের অভিভাবক ও আমাদের মুরব্বিদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবো।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মুফতি আমানুল হক জানান, ‘মাদরাসা থেকে কাউকে জোরপূর্বক আনা হয় না। তাদের উৎসাহমূলক কথা বলে আনা হয়েছে। ছাত্রদের বক্তব্য বিষয়ক যে ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়েছে তা বানোয়াট।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের আটক করে মারধার করার পর তাদেরকে এমন বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে।’
তিনি টঙ্গী ইজতেমার মাঠে সাদপন্থীদের হামলা যে পরিকল্পিত ছিলো তার প্রমাণ পেশ করে বলেন, ‘তারা হাতে ফিতা ব্যবহার করা হয়েছে সবুজ ও লাল। যা পরিকল্পনার প্রতি ইঙ্গিত বহন করেন।’
এই সমস্যার সমাধান এবং উভয় পক্ষের বোঝাপড়া সম্ভব কী না? এমন প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়ের বলেন, ‘আমি একই প্রশ্নের উত্তর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে দিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, ‘আমরা কুরআন ও হাদিসের উপর চলছি এবং তারা কুরআন-হাদিস বিকৃত করা একটি ভ্রান্ত মতবাদের উপর চলছে। এখন আমরা কুরআন-হাদিস ছেড়ে তাদের সাথে মিলবো নাকি তারা আমাদের সাথে মিলবে?
‘আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি যদি কুরআন-হাদিসের হয় তাহলে আমি আপোষ করাতে আসিনি। তা আমি জানি না। এই দেশ মুসলমানের দেশ। মুসলমান কখনো কুরআন-হাদিসের ব্যাপারে আপোষ করতে পারে না’, যোগ করেন মাওলানা যুবায়ের।
নির্বাচনের আগে ইজতিমা বন্ধের নির্দেশ সম্বলিত ইসির এক আদেশের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টঙ্গীর মাঠে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশে সাদপন্থি তাবলিগি মুরব্বি সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের নির্বাচন কমিশন বরাবর ২৪ নভেম্বর দাখিলকৃত একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে সংসদ নির্বাচনের আগে টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা স্থলে সব ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ঐ আবেদনে টঙ্গীর মাঠে তাবলিগ জামাতের কোনো অনুষ্ঠান হলে ময়দানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতেই নির্বাচন কমিশন অনুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা জারি করে চিঠি ইস্যু করে।
আর এভাবেই সাদপন্থী গোমরাহিরা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে টঙ্গীর ইজতিমা ময়দান ও তাবলিগকে কলঙ্কিত করেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।
এদিকে, তাবলিগ জামায়াতের বিভক্তিকে ইসলাম বিদ্বেষীদের চক্রান্ত বলে মন্তব্য করেছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব ও হাটহাজারী মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।
তিনি বলেন, যুগ যুগ ধরে তাবলিগের কাজ স্ব-মহিমায় চলে আসছে। তাবলিগ জামায়াতে কোনো দ্বিধা-বিভক্তি ছিল না। বর্তমানে তাবলিগ জামায়াতে বিভক্তি ও হতাহতের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ইসলাম বিদ্বেষীদের চক্রান্ত বলে আমি মনে করি।
টঙ্গীর ইজতেমার মাঠ দখল করতে উলামায়ে কেরাম, তাবলিগের সাধারণ সাথী এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের ওপর নগ্ন হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আল্লামা বাবুনগরী এসব কথা বলেন।
তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে ইজতেমার মাঠ দখল নিয়ে অপ্রীতিকর ও নির্মম ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান ও ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার গ্র্যান্ড ইমাম শাইখুল হাদিস আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ।
তিনি বলেন, ‘ইজতেমা ময়দান নিয়ে এরকম নির্মম লড়াই কেউ কামনা করে না। ইসলাম কখনোই এ ধরনের লাঠালাঠি, মারমুখি তাবলিগের কাজ সমর্থন করে না। এটা কখনো তাবলিগের কাজই হতে পারে না।’